ছোটবেলা থেকে আমরা একটা কথা শুনতে শুনতে বড় হয়েছি - সকল ধর্মই নৈতিকতার কথা বলে, সকল ধর্মই খারাপ কাজ করতে নিষেধ করে। কথা ১০০ ভাগ সত্য। কীভাবে করে? ধর্ম এই নৈতিকতার পাঠ কীভাবে পড়ায়?
প্রায় প্রতিটি ঈশ্বরবাদী ধর্মে জীবনকে দুটো ভাগে ভাগ করা হয় - ১) ইহকাল এবং ২) পরকাল। ব্যাপারটা কিছুটা এইরকম যেন ইহকাল হলো মানুষের পরীক্ষার জায়গা। এখানে মানুষের নানান বিষয়ে বিশেষ করে নৈতিকতার পরীক্ষা হবে (পশুপাখির আবার পরীক্ষা হয় না)। ইহকালের এই পরীক্ষার ফলাফল পাওয়া যাবে পরকালে অর্থাৎ মৃত্যুর পর। ব্যাপারটা বিভিন্ন ধর্মে বিভিন্নভাবে এলেও মোটাদাগে এসব পরীক্ষার ফলাফল হচ্ছে দুটো - স্বর্গ আর নরক, মাঝামাঝি আর কিছু নেই। ভালো কাজ করলে আপনি পাবেন স্বর্গের গ্যারান্টি আর খারাপ কাজ করলে পাবেন নরকের কষাঘাত। আবার কিছু অপরাধের ফলাফল কিংবা পূণ্যের সুবিধা ইহকালেও পাওয়া যায়। প্রকৃতি নিজেই বিচারক হয়ে নাকি বিচার করে দেয়। এছাড়াও রয়েছে ঈশ্বরকে নানাভাবে খুশি করার উপায়। কিছু কিছু কাজে ঈশ্বর খুশি হন, আবার কিছু কিছু কাজে নারাজ হন। তা যাই হোক, এই বর্ণনা মোটামুটি সব ধর্মেই কমন (বৌদ্ধধর্ম আর জৈনধর্ম বাদে)। একটু খেয়াল করলে দেখবেন উপরের বর্ণনায় দুটো বড় ব্যাপার লুকিয়ে আছে - ১) পুরস্কারের লোভ আর ২) শাস্তির ভয়। বলা হয় এই দুটো ব্যাপার দিয়েই মানবজাতিকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। হয়তো একটা যুগে ব্যাপারটা এরকমই ছিল। কিন্তু একটা মানুষ কেবল লোভ কিংবা ভয়ের বশবর্তী হয়ে নৈতিক - ব্যাপারটা শুনতে খুব ভালো শোনায় কি?
অধিকাংশ লোক নৈতিকতার সাথে এই লাভ-ক্ষতির ব্যাপারটা রিলেট করলেও দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট এই ব্যাপারটায় দ্বিমত পোষণ করেন। কান্ট মনে করেন, নৈতিকতা এতোটা বদ্ধ ব্যাপার নয়। বরং পুরস্কারের লোভ কিংবা শাস্তির ভয়ের সাথে যোগাযোগ থাকা উচিত নয়। কান্ট বলেন, ধরুন আপনি একটা বাচ্চা ছেলেকে একটা ভালো কাজ করতে বললেন এবং বিনিময়ে পুরস্কারের অঙ্গীকার করলেন। ছেলেটি আপনার কথামতো ভালো কাজটি করলো। আবার ক'দিন পরেই ছেলেটা আরেকটা ছেলের খেলনা ছিনিয়ে নিলো। এই অপরাধের শাস্তি হিসেবে আপনি ছেলেটাকে বাইরে কান ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখলেন। এতে ওর মাথায় দুটো কন্ডিশন গেঁথে গেল - ১) ভালো কাজ করলে পুরস্কার পাওয়া যায়, ২) খারাপ কাজ করলে শাস্তি পেতে হয়। সমস্যা এভাবে কন্ডিশন্ড হয়েই ছেলেটা বড় হয়ে দেখবে ভালো কাজ করলে আসলে তেমন একটা পুরস্কার পাওয়া যায় না আর খারাপ কাজ করলেও খুব শাস্তি হয় ব্যাপারটা তেমনও নয়। আসলে পৃথিবী এভাবে কন্ডিশন্ড হয়ে চলে না। তখন এই ছেলেটা কাজ করবে নিজের স্বার্থ বা লাভের বিনিময়ে। লাভ হলে সে ভালো কাজও করবে আবার খারাপ করতেও দ্বিধা বোধ করবে না। সমস্যাটা তৈরি হবে এখানেই। মনে মনে সে কন্ডিশন্ড থাকবে ঠিকই কিন্তু বাস্তবে সেটার প্রয়োগ হবে না। সুতরাং বোঝা গেল, নৈতিকতা আসলে এভাবে তৈরি হয় না। নৈতিকতাকে হতে হবে spontaneous. আমরা এমনিতেই ভালো হতে পারতাম, তার জন্য কোনো পুরস্কারের লোভ কিংবা শাস্তির ভয় প্রয়োজন ছিল না।
সমাজের সিস্টেম হচ্ছে একটা চেইন, সেই চেইনের অংশ হচ্ছে সেই সমাজের বাসিন্দারা। সমাজের বাসিন্দারা তাদের কাজগুলো ঠিকভাবে করলেই সেই চেইন কার্যকর থাকবে। অন্যথায় এরাই হবে একে অন্যের দুর্ভোগের কারণ। এখন আপনি অন্যের দুর্ভোগের কারণ হতে চান কিনা? নৈতিকতা হচ্ছে ব্যক্তি হিসেবে একজনের যেটা করা দরকার, সেটা করা - doing what needs to be done. লোভ নয়, ভয় নয়, আপনার কাজ আপনি ঠিকভাবে করলেই আপনি নৈতিক। সমাজের অংশ হতে হলে আপনাকে নৈতিক হতে হবে। অন্যথায় আপনি অন্যকে আর অন্যরা ভাগ্যকে দোষারোপ করতে থাকবে। এই দুষ্টচক্র চলতেই থাকবে, বন্ধ হবে না।
Comments
Post a Comment