Skip to main content

Conformism - দর্শনশাস্ত্রের প্রথম বাধা

 প্রাতিষ্ঠানিক রেজাল্টের ভিত্তিতে যদি ছাত্রদের ক্লাসিফিকেশন করা হয়, তাহলে মেডিকেল কলেজে আসার আগে আমি ছিলাম নিতান্ত নিম্ন-মধ্যবিত্ত সারির ছাত্র। ক্লাস এইটে গণিতে একবার আর ক্লাস নাইনে দুইবার উচ্চতর গণিতে ফেল করার নজির আছে। নজরুল স্যার নামের আমার একজন শিক্ষক প্রতিটা নিয়মের একটা করে অংক বোর্ডে করে দিয়ে তার দায়িত্ব শেষ করতেন। ঐ অংকের প্রয়োজনীয়তা কী, কেন করলাম, অ্যাপ্লিকেশন কী - এসব বোঝানোর প্রয়োজন বোধ করতেন না। অংক করতে পারলেই হলো। আমিও হুবহু সেই অংক কপি পেস্ট করে চালাতাম। শখে করতাম, তা নয়। কারণ, "স্যার, অংকটা বুঝিনি" বললে আমার পশ্চাৎদেশে Erythema করার জন্য যত ঘা বেত লাগানো প্রয়োজন, তার চেয়ে দু চার ঘা কম পড়তো বলে মনে পড়ে না। আমার স্কুলের কথা বাদ দিই, হয়তো বাংলাদেশের বেশিরভাগ স্কুলেই এরকম এক-দু'জন করে "নজরুল স্যার" আছেন। 


মেডিকেল কলেজে আসার পর দেখলাম, না বুঝলে প্রশ্ন করা যায়, এখানে মারের ভয় নেই। না বুঝলে শিক্ষকের রুমে গিয়েও আধা ঘণ্টা সময় লাগলেও যে কোনো টপিক বুঝে আসা যায়। এরকম সুযোগ আমি আগে কখনও পাইনি। এই সুযোগে আমার প্রশ্ন করার পরিমাণ বেড়ে গেলো, সব ক্লাসের শেষেই প্রশ্ন করতাম। আমার মনে হতো, প্রশ্ন না করা মানে কোনো টপিক পুরোপুরি বোধগম্য না হওয়া। একবার এক সিএমই শেষে ৫ টা প্রশ্ন করায় জনৈক শিক্ষক আমাকে আলাদা ডেকে একরকম শাসিয়ে ছিলেন। "এসব কে শেখায় তোমাকে? টিচারদের চেয়ে নিজেকে স্মার্ট প্রমাণ করতে চাও?" 

উল্লেখ্য, এরকম কোনো উদ্দেশ্যই আমার ছিল না। আমি শুধু টপিকটা বুঝতে চেয়েছিলাম। 

একটা দুই বছর বয়সী বাচ্চার প্রশ্ন শুনেছেন কখনও? আকাশ নীল কেন? বল গোল কেন? সাগরের পানিতে লবণ থাকে কেন? ওদের এত প্রশ্নে আমাদের মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়। অথচ চিন্তা করে দেখুন তো, এই প্রশ্নগুলোর কতগুলির উত্তর আপনি জানেন? জানলে বোধ করি বিরক্ত হতেন না। আমার কাছে মনে হয়, শিশুরাই সর্বোৎকৃষ্ট দার্শনিক। ওরা যেটা দেখে, তাতেই অবাক হয়, তাই এত প্রশ্ন করে। আমরা যতই বড় হই, ততই অবাক হতে ভুলে যাই। ফলে যা দেখি তাই বিনা প্রশ্নে মেনে নিই। এই মেনে নেয়ার ইফেক্ট যে কত বড়, তা যদি আন্দাজ করতে পারতেন, তাহলে বোধ করি পৃথিবী আরো কতকটা সুন্দর হতো।

 এতক্ষণ ধরে যে টপিকটার অবতারণা করতে চাচ্ছি, দর্শনশাস্ত্রে তাকে বলে Conformism - প্রথানুবর্তিতা। সহজ ভাষায় বললে - যা চলে আসছে, তা বিনা প্রশ্নে, বিনা তর্কে মেনে নেয়া। প্রশ্ন করলেই বিপদে পড়ে যাবেন। Conformism কে আমি দর্শনশাস্ত্রের সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে দেখি। কেন? উদাহরণ দিয়ে বলছি। অশিক্ষিতদের কথা না হয় বাদই দিন, সার্টিফিকেটধারী তথাকথিত শিক্ষিতদের মধ্যেও Conformism একেবারে মনের গভীরে বসে বাদাম চিবুচ্ছে। রাজারবাগ পুলিশ লাইনের সামনে যে ফ্লাইওভারটা আছে, তার বীমে লেখা - "ছোয়াঁচে রোগ বিশ্বাস করা হারাম এবং কুফরী।" এই চিকামারার কাজটি যেই প্রতিষ্ঠান করে থাকে, সেই প্রতিষ্ঠানের একটি হাসপাতালও আছে। নাম নিচ্ছি না সেই প্রতিষ্ঠানের। হাসপাতালটির পরিচালক আবার ডাক্তার। ভদ্রলোক বোধ হয় এমবিবিএস কারিকুলামে Scabies আর Tinea Corporis পড়তে ভুলে গেছেন। 


করোনাকালীন সময়ে বাংলাদেশের অনেক ইসলামি বক্তাগণ খোলা ময়দানে ঘোষণা করলেন, বাংলাদেশের মুমিন মুসলমানদের করোনা কিছুই করতে পারবে না। ভারতে অনেক হিন্দু পুরোহিত "করোনা মাতার পূজা" শুরু করলেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সায়েন্টিফিক রিপোর্টের কোনো তোয়াক্কা না করে এই ধর্মগুরুদের কথা শুনে মানুষজন মাস্ক ছাড়াই ঘুরতে লাগলেন। ফলাফল তো চোখের সামনেই দেখেছেন সবাই।


দোষারোপ তো অনেক হলো, এবার বৈজ্ঞানিকভাবে Conformism কে দেখার চেষ্টা করি। ডারউইনের বিবর্তনতত্ত্ব যারা পড়েছেন, তারা সহজে ধরতে পারবেন আশা করি। দেখা যায়, যেসব প্রাণী দলগতভাবে থাকে, তাদের মধ্যে Herd Instinct বলে একটা ব্যাপার থাকে - কিছু প্রথা, কিছু অভ্যাস, কিছু বিশ্বাস তারা নিজেদের মধ্যে শেয়ার করে যা দলগতভাবে থাকতে সাহায্য করে। এর কারণে দলগতভাবে এদের টিকে থাকার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। যে টিকে যাবে, সেই তার বংশধর রেখে যেতে পারবে এই ধরণীর বুকে। সুতরাং Survival জীবের জন্য একটা primary instinct এবং conformism এই instinct কে জাস্টিফাই করে। এজন্যই এটা এত বহুল প্রচলিত। কমফোর্ট জোনে থাকাও survival কে জাস্টিফাই করে, অন্যদিকে প্রচলিত মতের বিপরীতে যাওয়া, প্রচলিত প্রথার বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলা মানুষকে কমফোর্ট জোনের বাইরে নিয়ে আসতে চায়। এতে মানুষের survival instinct কিন্তু existential crisis অনুভব করে। এতে দলের মধ্যে Herd Instinct জাগ্রত হয় এবং প্রশ্নকর্তাকে দল থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হয়, শাস্তি দেয়া হয় অথবা মেরে ফেলা হয়।


বুদ্ধিজীবীর কাজই হলো এই প্রচলিত মতের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলা, তর্ক করা এবং এখনকার কথা না ভেবে একটা জিনিসের ইফেক্ট ভবিষ্যতে কী হতে পারে, তার নিরিখে কথা বলা। কিন্তু দুনিয়াব্যাপী "বুদ্ধিজীবিতার" একরকম অবনমন ঘটেছে বলবো না, বলবো অবনমন ঘটানো হয়েছে অথবা অবনমিত হতে বাধ্য করা হয়েছে। আজ আপনাকে পাড়াছাড়া আর কালকে দেহছাড়া করার ভয় দেখালে বুদ্ধিবৃত্তি যে চাঙ্গে উঠবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সক্রেটিস মরেছিলেন, ব্রুনো মরেছিলেন, কোপার্নিকাস কারাবরণ করেছিলেন। সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, কিন্তু তাঁদের জীবদ্দশায় নয়। অর্থাৎ, ঐতিহাসিকভাবেই সাধারণ মানুষ বাকস্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না। মুখে বাকস্বাধীনতার কথা বললেও ভেতরে তার উল্টোটাই বিরাজ করে। মানুষের কাছে সত্য আসবে, বারবার আসবে কিন্তু মানুষ সেই সত্য নেবে না। সেই সত্যপ্রচারকারীকে, সেই প্রশ্নকারীকে ধিক্কার দেবে, শাস্তি দেবে তবুও তার যুক্তির ধার তারা গ্রহণ করবে না। সুতরাং Every Buddha will be misunderstood & misinterpreted. 

১০ মে, ২০২৩।

২৬ শে বৈশাখ, ১৪৩০।


Comments

Popular posts from this blog

দেশপ্রেমের কাহিনি-কেচ্ছা

 একদা একদল মানুষ জঙ্গলে বসবাস করিতেন। তাহারা স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে শিকার করার পাশাপাশি ফলমূল সংগ্রহ করিয়া জীবিকা নির্বাহ করিতেন। কালের পরিক্রমায় সেই মনুষ্যদল ধাপে ধাপে আলু, ধান, গম ইত্যাদি শস্যের উৎপাদন করিতে শিখিলেন। কৃষিকার্যের উন্নতির ফলে উদ্বৃত্ত ফসল নামক আশীর্বাদরূপী সমস্যার উদ্ভব হইলো। জন্ম হইলো সম্পত্তির, পিতৃত্বের ধারণার অঙ্কুরোদগম হইলো। স্ত্রীলোকের স্হান নির্ধারিত হইয়া গেলো কুটিরে, সন্তান প্রতিপালন করাই হইয়া গেলো তাহার প্রধান কর্ম। এইদিকে, সম্পত্তির ভোগদখল লইয়া নানানরকম সমস্যা তৈরি হওয়ায় পুরুষগণ তাহাদের মধ্য সর্বাধিক বলশালী ব্যক্তিকে নিজেদের সম্পত্তি দেখভাল তথা বিভিন্ন অন্যায়ের বিচারের নিমিত্তে শাসনকর্তা তথা রাজা নির্বাচন করিলেন এবং তাহার ভরণপোষণের নিমিত্তে নিজেদের উদ্বৃত্ত ফসলের কিছু অংশ (খাজনা) উহাকে দিতে লাগিলেন। সেই রাজা বংশপরম্পরায় নিজের পদ ধরিয়া রাখিলেন এবং একসময় সবার সম্পত্তিকে নিজের ব্যক্তিগত সম্পত্তি অর্থাৎ রাজ্য বলিয়া ঘোষণা করিলেন। যাহারা রাজাকে "রাজা" নির্বাচন করিলেন, তাহারা "প্রজা" উপাধিপ্রাপ্ত হইলেন এবং অধঃস্তন বলিয়া গণ্য হইলেন। ব্যক্তিগত সম্

"সর্প হইয়া দংশন করো, ওঝা হইয়া ঝাড়ো"

 ইন্টার্নশিপের সময় আমি বেতন পেতাম না। তখন বাংলামোটরের ঐদিকে একটা টিউশনি করে চলতাম। মগবাজার ওয়্যারলেসের রাস্তাটা পার হয়ে সোজা হেঁটে যেতাম, ওটাই ছিল আমার নিয়মিত চলাচলের পথ। একদিন কী ভেবে যেন টিউশনিতে গেলাম না। সন্ধ্যার পরে একটা বিকট শব্দ হলো। বাসা থেকে বেরোতেই দেখি দলে দলে মানুষ ওয়্যারলেস গেটের দিকে ছুটে আসছে। এতদিন এই এলাকায় থাকি, এরকম কখনও দেখিনি। শুনলাম মগবাজার আড়ঙ এর অপরপাশে কিছু একটার বিস্ফোরণ হয়েছে, কিসের থেকে হলো তা তখনও অজানা। আহতরা দলে দলে আমাদের হাসপাতালের জরুরী বিভাগে ছুটে আসছে। আমিও ছুটে গেলাম সাহায্য করতে। গিয়ে দেখি সামি, সাবিনা, শ্রেয়াদের অ্যাপ্রন রক্ত আর ঘামে একাকার। Severely injured পেশেন্টদের একদিকে স্টিচ দিচ্ছি, অন্যদিকে ব্যান্ডেজের জন্য দৌঁড়াচ্ছি। এমন সময় একটা দুই বছরের বাচ্চাকে কোলে নিয়ে একজন দৌঁড়ে এলো, সম্পর্কে সে বাচ্চাটির মামা। বোন আর ভাগ্নেকে নিয়ে আড়ঙ এর উল্টোপাশে একটা ফাস্ট ফুডের দোকানে খেতে এসেছিলেন, বোনটা ইতোমধ্যে মারা গেছে, বাচ্চাটাও মৃত। তবুও আশা করে এসেছেন, যদি বাঁচানো যায়। বাচ্চাটার দিকে তাকালাম, দেহে প্রাণ নেই, সারা শরীরে কাচের টুকরো বিঁধে আছে। একটা একটা