"বাংলা ঘর" শব্দটি অামরা অনেক হিন্দী সিনেমা কিংবা নাটকে শুনে থাকি। অামি অাগে মনে মনে প্রশ্ন করতাম, এই "বাংলা ঘর" এর সঙ্গে কি বাংলার কোনো সম্পর্ক অাছে তাহলে? ড. মুনতাসীর মামুনের "ঢাকা সমগ্র ৪" পড়ার পর এ ব্যাপারে অামার ধারণা পরিষ্কার হয়। ড. মুনতাসীর মামুন তাঁর "ঢাকা সমগ্র" সিরিজের বইগুলোতে ঢাকার অাদি ইতিহাস, জন্মলগ্ন থেকে এখন পর্যন্ত সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর পরিবর্তনগুলো সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, ইচ্ছে করলে বইটি পড়ে ঢাকা সম্পর্কে অারো গভীর ধারণা পেতে পারেন। লেখকের মতে, তৎকালীন বাংলার ঘর তৈরির এক বিশেষ রকম শৈলীর জন্যই এর নাম "বাংলা ঘর"।
মুঘল শাসকগণ বাংলায় অাসার পর ঢাকাকে বাংলার রাজধানী করেন। কিন্তু বাংলার বেশিরভাগ জনসংখ্যাই ছিল গ্রামগুলোয় স্থায়ী। কিন্তু ঢাকাকে রাজধানী করতে হলে সেখানে লাগবে জনবসতি, লাগবে হাটবাজার, দোকানপাট। এমতাবস্থায় মুঘল শাসকগণ ঢাকায় জনবসতি স্থাপনের উদ্দেশ্যে লাখেরাজ সম্পত্তি দান করেন। এসব জমিতে রাজস্ব ছাড়াই বসবাস করা যেত। মুঘল অামলে ঢাকায় জনবসতি তৈরির মূল কারণই ছিল এই লাখেরাজ সম্পত্তি।
গৃহনির্মাণশৈলীর পেছনে পৃথিবীর সব জায়গাতেই গুরুত্ব পেয়েছে সেখানকার অাবহাওয়া ও জলবায়ু। জাপানে যেমন অতিরিক্ত ভূমিকম্পের জন্য কাগজ দিয়ে ঘরবাড়ি বানানো হয়। যেখানকার ভূমি একটু নিচু, সেখানকার লোকজন জলাবদ্ধতা থেকে বাঁচতে মাচার ওপর ঘর তৈরি করে। তাই ধরা হয়, বাংলা ঘর তৈরিতেও বাংলার অাবহাওয়াই পেয়েছে সর্বোচ্চ গুরুত্ব। তখনকার বাংলাকে মনে করা হতো নাতিশীতোষ্ণ (অন্তত ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায়)। বৃষ্টিপ্রধান অঞ্চল হওয়ায় এদেশের গ্রামগুলোতে বৃষ্টি বাদলের হাত থেকে বাঁচতে ঘরগুলোতে জানালা দেয়া হতো না বললেই চলে। প্রশ্ন অাসতে পারে,তাহলে অালো বাতাস প্রবেশের ব্যবস্থা কী ছিল? উত্তর সোজা। ঘরগুলো মূলত বাঁশ এবং ছনের তৈরি ছিল। ফলে ছোট ছোট ছিদ্র দিয়ে অালো বাতাস ঢুকতোই, অার চাল ছনের হওয়ায় পানি গড়িয়ে নিচে পড়ে যেত। এয়ারকন্ডিশনিং এর ফিজিক্স অনুসারে বড় ছিদ্রের তুলনায় ছোট ছিদ্র দিয়ে বাতাস ঢুকলে বাতাসের তাপমাত্রা তুলনামূলক কম হয়। ফলে ঘর ঠান্ডা থাকে জানালা না থাকা সত্ত্বেও।
মুঘল শাসকগণ ঢাকায় জনবসতি স্থাপনের জন্য লাখেরাজ সম্পত্তি দান করার পর গ্রাম থেকে লোকজন ঢাকায় স্থায়ীভাবে চলে অাসতে থাকে। মুঘলদের প্রভাবে তখন ঢাকায় (পুরনো ঢাকা, তখনকার ঢাকা শাঁখারীবাজার থেকে মিরপুর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল) চুন সুরকি দিয়ে ভবন নির্মাণ শুরু হলেও মানুষ তখনও তার গ্রামের গৃহনির্মাণ শৈলীর অাইডিয়া থেকে বের হতে পারেনি। ফলে এখানেও ভবনগুলোতে জানালার সংকট লক্ষ করা যায়। এ ধরণের ভবন নির্মাণ তখন বাংলা ছাড়িয়ে দিল্লীতেও কিছু কিছু দেখা যায়। বাংলার গ্রাম বাংলার গৃহনির্মাণ শৈলীর সাথে মিল ছিল বলেই সেই ভবনগুলোকে " বাংলা ঘর" বলা হতো। ঐতিহাসিকভাবে এ শব্দগুলো অনেক বেশি গুরুত্ব বহন করে,অামাদের অজ্ঞানতাবশত অনেক শব্দের ঐতিহাসিক মানে অামরা জানি না। এটা অামাদের ব্যর্থতাই বৈকি।
Comments
Post a Comment